মিজান সবেমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। এখন সে স্নাতক পর্যায়ে জন্য পড়াশোনা করতে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক। আমেরিকা-ইউরোপের বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য সে আবেদন করেছে কিন্তু এখনো কোথাও থেকে ডাক আসেনি। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ই আবেদন করার সময় মিজানকে একটি প্রবন্ধ লিখে জমা দিতে বলেছিল। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল মোটামুটি এমন, “Why are you willing to study in this university & why should the university admit you? (আপনি কেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চান এবং কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিবে?)” মিজান ভাবলো কেন সে কষ্ট করে একই প্রবন্ধ বারবার লিখতে যাবে? ইন্টারনেটের মাধ্যমে সার্চ করে সে অনুরূপ একটি প্রবন্ধ ডাউনলোড করে ফেলে। এরপর প্রবন্ধে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-ঠিকানা পালটে একই লেখা সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিল। বেশ কিছুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে মিজান যে আবেদন করেছিল তার উত্তর আসা আরম্ভ করল। সে লক্ষ্য করল, সবকয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরেই কোথাও না কোথাও লেখা আছে, “Due to plagiarism, your composition was invalidated & thus, we are sorry to inform you that our university could not accept your application for admission. (প্লেইজারিজমের দায়ে আপনার প্রবন্ধটি বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয় এবং অত্যন্ত দুঃখের সাথে আপনাকে আমরা জানাচ্ছি যে, আপনার ভর্তি আবেদন আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।)” আমরা প্রায়ই ইন্টারনেট অথবা অন্য ব্যক্তির থেকে তথ্য নিয়ে নিজেদের বলে চালিয়ে দেই। তথ্যগুলো হতে পারে কোন প্রশ্নের উত্তর, অন্যের লেখা গল্প/গবেষণা/জার্নাল/আর্টিকেল, কারো বক্তব্য কিংবা আরেকজনের তৈরি করা ছবি, ভিডিও, তথ্য, উপাত্ত। আমাদের প্রয়োজনে অন্য ব্যক্তির তৈরি করা তথ্য অনুমতি দেয়া থাকলে আমরা ব্যবহার করতেই পারি। কিন্তু এজন্য উল্লেখ করা (রেফারেন্স দেয়া) আবশ্যক যে কোথা থেকে এই তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। রেফারেন্স না দেয়ার কারণে আমরা প্লেইজারিজম নামক অপরাধে দায়ী হচ্ছি নিজেদের অজান্তেই।প্লেইজারিজম কী?অন্য কোন ব্যক্তির কাজ (লেখা, ছবি, কথা ইত্যাদি) তার অনুমতি ব্যতিরেকে এবং তাকে যথাযথ স্বীকৃতি না দিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করাকে প্লেইজারিজম বলা হয়। সহজ ভাষায় বললে, কারো তৈরি করা তথ্য তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করাই প্লেইজারিজম। সাধারণত নিম্নের কাজসমূহ প্লেজারিজম বা তথ্য চুরির আওতায় পড়ে -· অন্য কারো লেখা, চিন্তা ও বক্তব্য পরিবর্তন না করে অথবা আংশিক পরিবর্তন করে নিজের নামে প্রকাশ করা। উদাহরণস্বরূপ – হুমায়ূন আহমেদ এর একটি গল্পকে একটু এদিক-ওদিক পরিবর্তন করে কোন বইয়ের লেখক তার গল্পের জন্য ব্যবহার করলে বা নিজের গল্প বলে চালিয়ে দিলে তিনি প্লেইজারিজমের দায়ে অভিযুক্ত হবেন।· উৎস উল্লেখ না করে কোন ছবি বা লেখা নিজের কাজে কপি-পেস্ট করা। যেমন – গুগল থেকে প্রকৃতির একটি ছবি ডাউনলোড করে নিজের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা হলে সেটি প্লেইজারিজম।· আরেকজনের বক্তব্য ব্যবহার করার সময় উদ্ধৃত না করা। ধরা যাক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কোন প্রবন্ধের কয়েকটি লাইন কেউ একজন তার রচনায় লেখার সময় উদ্ধৃত চিহ্ন (“ “) না দিয়ে উল্লেখ করলে তা প্লেইজারিজম হিসেবে গণ্য হবে। · প্রকৃত উৎস প্রদর্শন ব্যতীত তথ্যের সারাংশ ব্যবহার করা। যেমন – ইন্টারনেট থেকে কোন বিষয়ের উপর তথ্য সংগ্রহ করার পর ওয়েবসাইটসমূহের লিংক উল্লেখ না করে ঐ তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করলে এটি প্লেইজারিজমের অন্তর্ভূক্ত হবে।প্লেইজারিজম রোধে তাই মূল লেখক অথবা প্রকৃত উৎস উল্লেখ করা অর্থাৎ রেফারেন্স প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রেফারেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু তথ্য প্রদর্শন করতে হয়। যেমন -১) লেখকের নাম: নিজের অ্যাসাইনমেন্ট, গবেষণা বা অন্য কোন প্রয়োজনে যদি কোন লেখকের বই, আর্টিকেল, থেকে তথ্য ব্যবহার করা হয় তাহলে অবশ্যই লেখকের নাম উল্লেখ করতে হবে। লেখক যদি দুইজন বা তিনজন হয়ে থাকেন, সেক্ষেত্রে সবার নামই উল্লেখ করতে হবে। তবে তিনজনের বেশি লেখক হলে প্রথমজনের নামের পরে ‘ও অন্যান্য’ লিখলেই চলবে। ২) প্রকৃত উৎসের প্রকাশকাল: কোন বই, জার্নাল, আর্টিকেল বা ডকুমেন্ট থেকে তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঐ ডকুমেন্ট কবে প্রকাশিত হয়েছিল তা লেখকের নামের পরে ব্র্যাকেটের ( ) মধ্যে লিখতে হবে। ৩) উৎসের শিরোনাম: যে বই, জার্নাল বা আর্টিকেল থেকে তথ্য নেয়া হবে তার শিরোনাম ইটালিক অক্ষরে (এভাবে বাঁকা করে) রেফারেন্সে লিখতে হবে। বইয়ের শিরোনাম লেখার ক্ষেত্রে সংস্করণ সংখ্যাও লেখা দরকার।৪) প্রকাশকের তথ্য: এটি কেবল বইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যে বই থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে তা কোন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত তা শিরোনামের পরে লিখতে হবে। সম্ভব হলে কোথায় প্রকাশিত হয়েছে তাও উল্লেখ করতে হবে।৫) পৃষ্ঠা নং: বইয়ের যে পৃষ্ঠা থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে সেটি লিখতে হবে। পরপর কয়েকটি পৃষ্ঠা থেকে তথ্য নেয়া হলে প্রথম পৃষ্ঠা নং ও শেষ পৃষ্ঠা নং এর মাঝে একটি হাইফেন চিহ্ন ( - ) দিতে হবে।৬) ইউআরএল (URL) এবং তথ্য সংগ্রহের তারিখ: কোন ওয়েবপেইজ থেকে নিজের প্রয়োজনে তথ্য সংগ্রহ করা হলে অবশ্যই ঐ ওয়েবপেইজের ইউআরএল বা ওয়েব অ্যাড্রেস প্রদর্শন করতে হবে এবং ওয়েবপেইজটি থেকে কবে তথ্যটি নেয়া হয়েছে সেটি লিখে দিতে হবে।৭) জোড় উদ্ধৃতি চিহ্ন: কোন ব্যক্তির কথা বা বক্তব্য হুবুহু ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই কোট করে দিতে হবে অর্থাৎ জোড় উদ্ধৃতি চিহ্ন দিয়ে আটকে দিতে হবে। যেমন – “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।“উদাহরণ: আবুল মনসুর আহমদ এর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইটির ২০১৬ সালের সংস্করণ যা ঢাকার খোশরোজ কিতাব মহল থেকে প্রকাশিত হয় সেই বই থেকে আপনি কিছু তথ্য আপনার কোন একটা প্রবন্ধ বা অ্যাসাইনমেন্টে ব্যবহার করেছেন। সেক্ষেত্রে লেখার ভেতরে রেফারেন্স দিতে হবে এভাবে- আবুল মনসুর আহমদ (২০১৬) তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, “১৯৩৪ সালে জিন্নাহ সাহেব তাঁর লন্ডনের স্বয়ং নির্বাসন ত্যাগ করিয়া বোম্বাই আসেন। সঙ্গে সঙ্গেই কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত হন।” অথবা,মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৩৪ সালে লন্ডন থেকে বম্বে আসেন। আসার পর পরই তিনি কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন (আবুল মনসুর আহমদ, ২০১৬)শেষে তথ্যপঞ্জিতে এর উল্লেখ হবে এভাবে- আবুল মনসুর আহমদ, (২০১৬), আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা: খোশরোজ কিতাব মহল, পৃষ্ঠা ৮৮। ধরা যাক, প্রাথমিক শিক্ষকদের ডিপিএড প্রোগ্রামের ‘পেশাগত শিক্ষা: ১ম খণ্ড’ নামক একটি বই থেকে শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্টের জন্য কিছু তথ্য নিয়েছেন। বইটিতে ৫ জন লেখক আছে যার মধ্যে প্রথম জনের নাম শারমিন হক। বইটি ২০১৯ সালে ময়মনসিংহ এ অবস্থিত জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে লেখার ভেতরে এর উল্লেখ করতে হবে এভাবে- মূল্যায়ন দুই ধরনের- গাঠনিক এবং সামষ্টিক। আমরা বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন অগ্রগতি যাচাইয়ের জন্য সাধারণত গাঠনিক মূল্যায়ন করি (শারমিন হক, ২০১৯)। শেষে তথ্যপঞ্জিতে এর উল্লেখ হবে এভাবে- শারমিক হক ও অন্যান্য, (২০১৯), ডিপিএড পেশাগত শিক্ষা: ১ম খণ্ড, ময়মনসিংহ: জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, পৃষ্ঠা ৫২। তথ্য চুরি বা প্লেইজারিজমের দায়ে অভিযুক্ত না হওয়ার জন্য রেফারেন্স প্রদান করা কতটা জরুরী তা আমরা এখন বুঝতে পারছি। তাই আমাদের নিজেদের কাজে যখনই অন্য কারো তথ্য ব্যবহার করতে হবে, অবশ্যই আমরা উপযুক্ত তথ্য উল্লেখের মাধ্যমে রেফারেন্স প্রদান করব।
আরও জানুন