বর্তমান সময়ে আমরা যেন তথ্যের সাগরে ভেসে আছি। অজস্র তথ্যের প্রবাহ আমাদের চারপাশে। কিন্তু এগুলোর কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা যাচাই করা বেশ কঠিন। তাই এর সুবিধা- অসুবিধা দুইই আছে। ইদানীং অনলাইন মাধ্যমে অসত্য তথ্য প্রকাশ বেশি হওয়ায় সচেতন মানুষ অনেক অনলাইন মাধ্যমের উপর আস্থা রাখেন না। কিন্তু দেশের সকলেই এই ব্যাপারে সচেতন না থাকায় ঘটে যায় নানান অবাঞ্ছিত ঘটনা। যেমন একটা সময় পত্রিকায় ভুল তথ্য ছড়িয়ে দাঙ্গা লাগানো থেকে শুরু করে সমাজের সামগ্রিক শান্তি নষ্ট করা হত। অনলাইন মাধ্যমে কম সময়ে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব এবং অনেক বেশি মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা সম্ভব। সাধারণ মানুষকে কারো বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে সাম্প্রদায়িক হামলা, সাইবার বুলিং, অনলাইনে অপদস্থ করার ঘটনা বাংলাদেশে খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে গেছে। এর ক্ষতিকর প্রভাব যে কত বেশি তা বুঝে বা না বুঝেই যারা এই কাজগুলো করছেন তাদেরসহ সকলেরই এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।
অনলাইনে অসত্য ও সংবেদনশীল তথ্য প্রকাশে কী সমস্যা হতে পারে?
সঠিক তথ্য বাছাই করা কঠিন হয়ে যায়
হাজারো তথ্যের মধ্যে সঠিক তথ্য বাছাই একরকম কঠিন হয়ে গেছে। একটা সময় ছিলো যখন মানুষের কাছে তথ্য খুব একটা সহজলভ্য ছিলো না। এখন এই তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে তথ্য এত সহজলভ্য থাকার পরেও মানুষের মধ্যে এত এত ভুল ধারণার পিছনে বড় একটা কারণ হল সঠিক তথ্যের অভাব। অন্যভাবে বলতে গেলে তথ্যের অনেক উৎস থেকে সঠিক তথ্যটা খুঁজে বের করার ক্ষমতার অভাব। মিথ্যা তথ্য অনেক বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পরলে বেশিরভাগ মানুষই সঠিক তথ্য খুঁজে পাবে না। ভুল তথ্য জেনে বিভ্রান্ত থাকবে, বিপদে পড়বে ।
অনলাইন মাধ্যমগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে যায়
আশপাশের অনেককেই বলতে শুনবে নিত্যব্যবহার্য কোন কোন পণ্যে হারাম দ্রব্য মেশানো তাই ব্যাবহার করা যাবেনা। তারপর পঙ্গপাল আসছে দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হবে এমন সব আজগুবি কথা প্রচার করা হয়। এ ধরনের মিথ্যা তথ্য অনেক বেশি প্রচারের ফলে এই ভুল ব্যাপারগুলো অনেক বেশি প্রচার পেয়ে যায়।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব কমে যায়
অনলাইন মাধ্যম মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এখন যে কেউ চাইলেই অনলাইনে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা করতে পারে। মিথ্যা তথ্যের অনেক বেশি প্রসারের জন্যে মানুষের বাক-স্বাধীনতা এবং সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর অনাস্থা চলে আসে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করে
মিথ্যা তথ্য যারা ছড়ায় তাদের বড় একটা অংশ বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে ভুল বুঝিয়ে মানুষকে এগুলো থেকে নিরুৎসাহিত করে। যেগুলো দিয়ে প্রভাবিত হয়ে অনেকেই আধুনিক চিকিৎসা, প্রযুক্তি ব্যাবহার করতে নিরুৎসাহিত হয়। কোন আপদকালীন অবস্থায় অনেক মানুষ এদের অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে নিরাপত্তায় অবহেলা করে। বৈজ্ঞানিক সত্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও ভুল ধারণা তৈরি করে।
মানুষের জীবনের উপর হুমকি আসতে পারে
ধর্মীয় বিশ্বাসের মত ব্যাপারগুলো এদেশে খুবই স্পর্শকাতর। এসব বিষয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে সহজেই সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তাদের ব্যাবহার করা যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনলাইন মাধ্যমে অনেকেই অসত্য তথ্য ছড়ায়। যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একদল মানুষ অন্য মানুষের ঘরবাড়িতে হামলা, খুন, ধর্ষণের মত বড় ধরণের অপরাধ করে ফেলে।
সঠিক তথ্যের গুরুত্ব কমে যাচ্ছে
অনলাইনে অপ্রয়োজনীয় ও মিথ্যা তথ্যের আধিক্যের কারণে সঠিক এবং জরুরি তথ্যগুলোও প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়না। মনে করুন অনলাইনে কেউ সাহায্যের আবেদন করেছে। অতীতে যদি কোন মিথ্যা সাহায্যের আবেদনে সাহায্য করে ঠকে থাকেন তাহলে পরবর্তী কারো প্রয়োজনে সাহায্য করতে আগ্রহ পাবেন না।
মূল্যবান সময় ও মেধা নষ্ট হচ্ছে
মিথ্যা তথ্যের পাঠক, লেখক, প্রকাশক সকলেরই এসব অপ্রয়োজনীয় তথ্য তৈরি ও পাঠ-সূত্রে অনেক সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। যে সময়টা সকলেই হয়তো কোন সৃজনশীল কাজে ব্যয় করা যেতো।
মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস জন্ম নেয় এবং পারস্পরিক বন্ধন আলগা হয়ে পড়ে
মানবসমাজের জন্য অনবরত মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রকাশের চূড়ান্ত পরিণতি ভয়াবহ। মানুষ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ধরতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং তারা কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারে না। ফলে দিন দিন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং বিছিন্ন হয়ে পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে সমাজ এবং জাতি দুর্বল হতে থাকে, জনজীবনের সুখ- সমৃদ্ধি বিনষ্ট হয়।
অনলাইন মাধ্যমের পরিবেশ আমাদের জীবনে অনেক বড় প্রভাব রাখে। সেজন্য এখানের সামগ্রিক অবস্থা যত বেশি ভালো হবে, আমাদের সকলের জন্যেই তত ভালো হবে ব্যাপারটা। মিথ্যা তথ্যে প্রভাবিত না হয়ে সঠিক তথ্য জেনে কার্যকর অনলাইন আচরণ সকলেরই কাম্য।