অনলাইন সেবা, অ্যাপ ও ডিভাইসের অতি ব্যবহারের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসমূহ

বিশ্বে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকেই যে বিকর্ত চলছে তা হলো প্রযুক্তি আশির্বাদ নাকি অভিশাপ? প্রযুক্তির উত্তোরত্তর সমৃদ্ধির সাথে এই বিতর্কও গতি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে অতিরিক্ত যে কোন কিছুই ক্ষতিকর। যে কোন ডিজিটাল ডিভাইস যদি সঠিক নিয়মে ব্যবহার করা না হয় অথবা যদি অতিরিক্ত সময় ধরে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ব্যবহারকারী বিভিন্ন রকমের ক্ষতির শিকার হতে পারেন। মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার এর অতিরিক্ত ব্যবহারে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থগত ঝুঁকি আছে। এমনকি ক্যান্সারের মত ভয়াবহ সমস্যার শুরু হতে পারে এখান থেকে। ডিজিটাল ডিভাইস এর অতিরিক্ত ব্যবহারের যে সকল সমস্যা হতে পারে: 

মোবাইলের অতি ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকি: 

 (১) অমনোযোগিতা: এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, যারা সারাক্ষণ তাদের ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তারা যে কোন জরুরী পরিস্থিতিতে অন্যদের তুলনায় দেরিতে সক্রিয় হন। বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, মোবাইল ফোন আমাদের কোন কাজের প্রতি একাগ্রতা নষ্ট করে দেয়। এর ফলে যে কোন কাজ করতে আমাদের স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে।  

(২) সাধারণ অসুস্থতা: তুমি সারাক্ষণই তোমার প্রিয় ফোনটি নিয়ে ব্যস্ত থাকো। এতে ধূলোবালি তো জমা হয়ই, সাথে থাকে অনেক রোগ-জীবাণুও। খাবার সময় হয়তো মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে করতে বা কোন কল/মেসেজ রিপ্লাই করতে গিয়ে এই ডিভাইস থেকে প্রায় ২০ থেকে ৩০ ভাগ ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস খাবারের সাথে তোমার দেহে প্রবেশ করলো। হয়ত তুমি সাথে সাথে অসুস্থ হবে না, কিন্তু পরবর্তীতে যেকোন অসুস্থতার জন্য এই বিষয়গুলোই দায়ী থাকবে। 

(৩) চোখের সমস্যা: দীর্ঘক্ষণ এবং চোখের খুব কাছে ফোন ব্যবহার করলে মাথাব্যথা, চোখ ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা-এরকম নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। এযে সকল শিশু মোবাইল গেম, কার্টুন এসবের প্রতি আসক্ত তাদের তাদের চোখের সমস্যার সম্ভাবনা বেশী থাকে।  

(৪) স্নায়বিক সমস্যা: মোবাইল ফোনের তেজস্ক্রিয়তা মস্তিষ্কে মেলাটনিনের (এক ধরনের হরমোন যা ঘুমে সহায়তা করে) পরিমাণ হ্রাস করে, যার ফলে ব্যবহারকারীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে এবং বিভিন্ন স্নায়বিক সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া এটি এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, মোবাইল ফোন থেকে নিঃসরিত তড়িত-চৌম্বকীয় তরঙ্গের কারণে অনিদ্রা, আলঝেইমার ও পারকিনসন’স রোগের মত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। 

(৫) হার্টের সমস্যা: গবেষণায় জানা গিয়েছে, মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা মানুষের হার্টের স্বাভাবিক কর্মকান্ডকে ব্যহত করে। এর ফলে রক্তের লোহিত রক্তকণিকাতে থাকা হিমোগ্লোবিন আলাদা হয়ে যেতে থাকে। এছাড়া হিমোগ্লোবিন রক্তের লোহিত কণিকার মাঝে তৈরি না হয়ে দেহের অন্যত্র তৈরি হতে থাকে, যেটি বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। 

(৬) শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া: যারা দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোনে কথা বলেন তাদের কানের বিভিন্ন সমস্যা যেমন-কানে কম শোনার ঝুঁকি অনেক বেশি।  দৈনিক ২-৩ ঘন্টার বেশী সময় মোবাইলে উচ্চ শব্দে গান শোনা, কার্টুন দেখা, গেম খেলার সাথে জড়িত শিশুরা আংশিকভাবে বধির হয়ে যাওয়ার ঝুকিতে থাকে। 

(৭) মস্তিষ্কের ক্যান্সার: মোবাইল ফোন থেকে সৃষ্ট তেজষ্ক্রিয় রশ্মি আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলতে পারে অথবা এর বেতার তরঙ্গ আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে উত্তপ্ত করে তোলে। তাই মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার মস্তিষ্কের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। 

কম্পিউটারের অতি ব্যবহারে স্বাস্থ্য ঝুঁকিঃ 

ব্যবসা বানিজ্য, অফিস, উচ্চশিক্ষা বাদেও কম্পিউটার এখন স্কুলের শিশুদের জন্যও প্রয়োজনীয়। অনলাইনে ক্লাশ করা ছাড়াও স্কুলের বিভিন্ন অ্যাসায়েনমেন্ট এর কাজেও কম্পিউটার ব্যবহার করা হয়। এগুলো বাদেও কম্পিউটার গেম খেলা, গান, সিনেমা দেখা এবং অন্যান্য কাজেও শিশুরা কম্পিউটার ব্যবহার করে। একটানা অনেকক্ষণ কম্পিউটার এর ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতিকর। বিভিন্ন জটিল রোগের জন্ম হতে পারে একটানা অনেকক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে। এরকম কিছু সমস্যার বিষয়ে আলোচনা করা হলোঃ 

১। কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে বসে থাকার কারণে পিঠের ওপর ক্রমাগত চাপ পড়ে ও দেহে রক্ত চলাচল ব্যহত হয়। দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে থাকাটা শরীরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তারপরে যদি সেই বসাটা সঠিকভাবে না হয় তাহলে ব্যাকপেইন সহ আরও মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। এছাড়া দীর্ঘসময় কম নড়াচড়ার কারণে কম পরিমাণ ক্যালোরি খরচ হয় এবং আমাদের অজান্তেই ওজন বৃদ্ধিসহ হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের মতো জটিলতা তৈরি হতে পারে।  

২। একদৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ে। এরফলে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া সহ চোখের অস্বস্তি, চোখ জ্বালা, চোখ শুকিয়ে যাওয়া, লাল হয়ে ওঠা, চোখ চুলকানো, মাথাযন্ত্রনা হতে পারে। অনেকক্ষণ ধরে কম্পিউটার গেমস খেলে যেসব শিশু তাদের চোখে এই সমস্যাগুলো সহজেই চিহ্নিত করতে পারবে যে কেউ।   

বিশ্বের প্রায় সাত কোটি কর্মী কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোমের ঝুঁকিতে রয়েছেন আর সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছেই। দিনে মাত্র তিন ঘণ্টা কম্পিউটার ব্যবহার করলেও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যাঁরা আরও বেশি সময় ধরে কম্পিউটারে কাজ করেন, তাঁদের টানা মাথাব্যথা, ঘাড় ও পিঠে ব্যথাও হয়। 

তাই একটানা মোবাইল বা কম্পিউটারের দিকে না তাকিয়ে, কাজ করে মাঝে মধ্যে বিরতি নেওয়া জরুরি। প্রতি ১৫-২০ মিনিট পর পর একটু বিরতি নিয়ে উঠে দাঁড়ানো এবং পায়চারি করা দরকার। চেয়ারে ঘাড় ও পিঠ সোজা রেখে বসে কাজ করতে হবে এবং কম্পিউটার এমন দূরত্বে রেখে কাজ করা যেন ঝূঁকে দেখতে না হয়। হাত, কবজি, হাত ও উরু মেঝের সমতলে রেখে কাজ করতে হবে। এভাবে নিয়ম মেনে ব্যবহার করলেই সুস্থ্য থাকা সম্ভব।